মার্কিন উদ্যোক্তা এলন মাস্কের জন্ম ২৮ জুন, ১৯৭১। ইন্টারনেটভিত্তিক অর্থ আদান-প্রদান সেবাপ্রদানকারী ওয়েবসাইট পেপালের সহপ্রতিষ্ঠাতা তিনি। ২০১২ সালের ১৫ জুন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির সমাবর্তনে তিনি এ বক্তব্য দেন।
প্রথামাংশ –
উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা।
আমি ভাবছিলাম, আপনাদের ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় এমন কী বললে আপনাদের উপকার হবে। আমি এখন যে অবস্থানে আছি, তার কথা আপনাদের শোনালে, সেই জীবনের গল্প আপনাদের জন্য অনুপ্রেরণার হবে। কী শিক্ষণীয় আছে সেই গল্পে?
তরুণ বয়সে আমাকে যখন সবাই জিজ্ঞেস করত, আমি কী হতে চাই। তখন আমি জানতামই না, বড় হয়ে আমি কী হতে চাই। তার পরও ভাবতাম, কোনো কিছু উদ্ভাবনের মতো অদ্ভুত কাজ আর হতে পারে না। আমার এই অদ্ভুত ভাবনার পেছনের কারণ ছিল, বিজ্ঞান কল্পকাহিনির লেখক আর্থার সি ক্লার্ক। তাঁর লেখায় জেনেছিলাম, ?একটি পরিপূর্ণ উন্নত প্রযুক্তি সহজেই জাদু থেকে আলাদা করা যায়।? এখন আকাশে ওড়া সম্ভব। আপনি যদি ৩০০ বছর আগে ফিরে গিয়ে আকাশে ওড়ার গল্প কাউকে বলতেন, তা হলে আপনাকে নির্ঘাত আগুনে পোড়ানো হতো। ইন্টারনেট এমনই একটি মাধ্যম, যা দিয়ে আপনি সহজেই অনেক দূরের জিনিস দেখতে পারেন, যোগাযোগ করতে পারেন। নিমেষেই চোখের পলকে প্রবেশ করতে পারেন পৃথিবীর তথ্যের জ্ঞানভান্ডারে। ইন্টারনেটকে আপনি জাদুই বলতে পারেন।
এখন অনেক কিছু বাস্তবে দেখা গেলেও সেগুলো কিন্তু অতীতে কল্পনার জগতেও বাস করত না। আমরা সেই অতীতের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছি। এমন কোনো কিছু করাই আমার ইচ্ছা ছিল, যা জাদুর মতোই লাগবে এবং অদ্ভুত মনে হবে। সব সময় ভাবতাম, কোনো কিছু থাকার মানে কী? খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম সেই রহস্য। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, পৃথিবীর জ্ঞানবিজ্ঞানের জগৎ উন্নত করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সচেতনতার মাত্রা বাড়াতে হবে। তা হলেই আমরা আলোকিত মানুষ হতে পারব। সঠিক প্রশ্ন করার গুণ অর্জন করতে পারব। এই দিয়েই পৃথিবীবাসী প্রগতির পথে আরও এগিয়ে যাব।
এ জন্যই হয়তো আমি পদার্থবিজ্ঞান আর অর্থনীতি পড়া শুরু করেছিলাম। কারণ, এ জন্য আপনাকে অনেক জানতে হবে। পৃথিবী কীভাবে কাজ করে, অর্থনীতি কী করে এবং সাধারণ মানুষকে একসঙ্গে আনার কৌশল জানতে হবে। এগুলো দিয়েই তৈরি হবে আপনার উদ্ভাবন। এককভাবে আপনার পক্ষে এখন কোনো কিছু করা প্রায়ই অসম্ভব।
১৯৯৫ সালে আমার চিন্তা ছিল, ইন্টারনেট নামের নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার চেষ্টা করা। সফলতা আসবে কি না, আমি জানতাম না। কারণ, সফলতা বেশ কঠিন একটি চক্কর। আপনার হাতে সে ধরা দেবে কি না, আপনি কখনোই জানবেন না। আমি শুধু প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হতে চেয়েছিলাম। সে জন্য আমি যা করেছিলাম, তা আপনাদের কখনোই অনুকরণের পরামর্শ দেব না। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ড্রপ আউটের সিদ্ধান্ত নিই এবং ইন্টারনেট নিয়ে কাজ শুরু করি। এ রকমই আমার একটা কাজ ছিল, ইন্টারনেটে অর্থ আদান-প্রদানের জন্য পেপাল প্রতিষ্ঠা। এখন পেপাল অনেক জনপ্রিয় হলেও শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না। প্রথমে আমরা সব ধরনের আর্থিক সেবা এই সাইটের মাধ্যমে দিতে শুরু করলাম। কেউ আমাদের কথা শুনল না। আমরা তখন অনেক সময় নিয়ে সবাইকে ই-মেইলের মাধ্যমে লেনদেনের কথা বোঝালাম। সেই চেষ্টার ফল আপনারা এখন পেপালের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন।
পেপালের পর আমি চিন্তা করেছিলাম, কোন সমস্যাগুলো মানুষের ভবিষ্যতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
মানুষের জীবনকে এক পৃথিবীকেন্দ্রিক না রেখে বহু গ্রহকেন্দ্রিক করলে ভবিষ্যতের মানুষের উপকার হবে। এ জন্য আমি উদ্যোগ নিলাম স্পেসএক্স প্রতিষ্ঠার।
আমি মঙ্গলে অবতরণ করার কথা না ভবে সহজলভ্য মহাকাশ যোগাযোগব্যবস্থায় মনোযোগ দিলাম। সেই থেকে শুরু স্পেসএক্সের। আমি একা কিছুই করতে পারব না। একাকী কঠিন পথ পার হওয়া বেশ হতাশাজনক। আত্মপ্রত্যয়ী কয়েকজন মানুষ নিয়ে আমার দল গঠন করলাম। যাত্রা শুরু করলাম দুর্জয়কে জয় করার।
শেষাংশ –
২০০৮ সালে আমরা প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ করি। আমরা সফল হই। না হলে সর্বনাশ ছিল। কারণ, সব টাকা-পয়সা আমরা বিনিয়োগ করে ফেলেছিলাম। আমাদের সব টাকার বিনিয়োগের ফলাফল রকেটটি যখন পৃথিবীর কক্ষপথে পৌঁছাল, তখন আমরা বিশ্বজয়ের সাধ পেয়েছিলাম। গুরুত্বসহকারে মহাকাশে গমন নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমরা ফ্যালকন ১ নভোযানকে আকাশে পাঠাতে সক্ষম হই। সবশেষে ড্রাগন নভোযান নির্মাণে মনোযোগ দিই।
আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারি না, আকাশে আমার নভোযান গিয়েছে। ভবিষ্যতের মানুষকে বহু গ্রহের বাসিন্দা হতে হলে আরও গবেষণা করতে হবে। হয়তো সেই গবেষণার সঙ্গে আপনারা অনেকেই ভবিষ্যতে অংশ নেবেন। সাফল্য লাভে ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর বয়স চার বিলিয়ন বছরের বেশি, কিন্তু তার চেয়েও তরুণ আমাদের মানবসভ্যতার বয়স। আমরা মাত্র ১০ হাজার বছর ধরে লিখতে পারি। এটিই আমাদের মানবসভ্যতার সাফল্য। আমি সব সময়ই ভবিষ্যৎ পৃথিবী নিয়ে আশাবাদী। আমাদের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, তার পরও আশাবাদী।
আপনি যদি নিজের কোম্পানি চালু করতে চান, তা হলে আপনাকে কাজপাগল হতে হবে। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে সবকিছু দেখতে ভালো লাগে, সেখানে আপনি যা ইচ্ছা তা-ই বানাতে পারেন। কিন্তু আপনি যদি আপনার কাজের নমুনা তৈরি করে সবাইকে দেখান, সেই নমুনা দেখতে আকর্ষণীয় না হলেও, অনেকেই আপনার কাজের প্রতি আগ্রহী হবে।
যেখানেই কোনো কিছু ঘটে, সেখান থেকে কিছু না কিছু শিক্ষা লাভ করা যায়। আপনারা তরুণেরা একুশ শতকের জাদুকর। কোনো কিছুই আপনাদের আটকে রাখতে পারবে না। কল্পনার মাত্রা হয়তো সীমিত। কিন্তু সেই সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেও আপনারা নতুন কোনো জাদু ও চমক সৃষ্টি করে বদলে দিতে পারেন ভবিষ্যৎ পৃথিবীর ইতিহাস।
সবাইকে ধন্যবাদ।
[প্রথম-আলো থেকে সংগৃহীত]